বিবাহের টুকিটাকি
বিবাহের টুকিটাকি
আজ মানুষ নানাভাবে
অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে। বধূহত্যা আজ প্রায় নিত্যদিনের খবরে দেখা যায়। বিবাহবিচ্ছেদ
আকছার হচ্ছে। সামান্য কারণেই স্বামী-স্ত্রী একে অন্যকে অবিশ্বাস করে। ফলে সংসারে
খিটিমিটি লেগেই থাকে। ভুল বোঝাবুঝির জেরে সারাটা জীবন কষ্ট ভোগ করতে হয়। এর কারণ
অনুসন্ধান করতে গিয়ে অনেকেই নানা গুরুগম্ভীর তত্ত্বকথা বলেন। হয়তো কিছু ঠিক, হয়তো
বা কিছু ঠিক নয়। আমিও একটা কথা বলি, না এটা কোন তত্ত্বকথা নয়, আমার ভাবনা মাত্র।
এর মধ্যে সামান্যতম কোন remedy যদি খুঁজে পাওয়া যায়, সেই বিষয়ে আপনারা আপনাদের নিজস্ব
মতামত দেবেন।
বিবাহিত পুরুষ ও
স্ত্রীকে একসঙ্গে বলা হয় ‘দম্পতী’। জায়া চ পতিঃ চ –দম্পতী। (দ্বন্দ্বসমাস)। স্বামী–স্ত্রীর
যুগলরূপ। একজন না থাকলে দম্পতী শব্দই অর্থহীন।
আমি সংস্কৃত সাহিত্যের
বিখ্যাত দু’জন নাট্যকারের রচনা থেকে সামান্য কিছু অংশ উদ্ধৃত করে
ব্যাপারটা বলার চেষ্টা করছি।
সংস্কৃত সাহিত্যের
বিখ্যাত দু’জন নাট্যকার কালিদাস ও ভবভূতির নাটকে আমরা দাম্পত্য প্রেমের পরিপূর্ণ
আদর্শগত রূপের সন্ধান পাই। আমি অল্প কয়েকটি জায়গার উল্লেখ করছি। উৎসাহী পাঠকেরা
মূল বইগুলো পড়লে আরো অনেক কিছু জানতে পারবেন।
মহাকবি কালিদাস প্রেমের
পূর্ণ রূপের দ্রষ্টা, কিন্তু তা শেষপর্যন্ত বিশ্রান্তি লাভ করেছে দাম্পত্য প্রেমের
মধ্যে। তাঁর কাব্য-নাটকে সর্বত্রই তা দেখা যায়।
রঘুবংশের অষ্টম সর্গে
পত্নী ইন্দুমতীর মৃত্যুতে অজের বিলাপের মধ্যে জানা যায় তিনি কী চোখে ইন্দুমতীকে
দেখতেন—
‘গৃহিণী সচিবঃ সখী মিথঃ প্রিয়শিষ্যা
ললিতে কলাবিধৌ।
করুণাবিমুখেন মৃত্যুনা হরতা ত্বাং বদ
কিং ন মে হৃতম্।।‘(৬৭)
এখানে অজ ইন্দুমতীকে গৃহিণী, পরামর্শদাতা সচিব এবং সখী বলে
উল্লেখ করেছেন।
শকুন্তলা নাটকে দেখা যায়—
পুত্র সর্বদমনের মাধ্যমে শকুন্তলার সঙ্গে দুষ্যন্তের
পুনর্মিলন হয়।
দুষ্যন্ত শকুন্তলাকে প্রত্যাখ্যান করে পরে অনুতাপে দগ্ধ হয়ে
নবতর উপলব্ধি লাভ করেন। নিজের অনিচ্ছাকৃত ভুল বুঝতে পেরে শকুন্তলার প্রতি যে
অন্যায় অবিচার করেছিলেন তার জন্য শকুন্তলার পায়ে ধরে ক্ষমা চান। তিনি সংসারে
ধর্মপত্নী ও সন্তানের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে
পারেন। তাই দেখি মহর্ষি মারীচ যখন দুষ্যন্তকে জিজ্ঞাসা করেন—
‘বৎস, কচ্চিদভিনন্দিতস্ত্বয়া
বিধিবদস্মাভিরনুষ্ঠিত-জাতকর্মা পুত্র এষ শাকুন্তলেয়ঃ?’
(শকুন্তলার পুত্রকে তুমি কি অভিনন্দন জানিয়েছ?)
দুষ্যন্ত বলেন—‘ভগবন্, অত্র খলু মে বংশপ্রতিষ্ঠা।‘
স্বামী ও স্ত্রীর
সম্পর্কের আসল রূপ কেমন সে সম্বন্ধে ভবভূতি মালতীমাধব প্রকরণে কামন্দকীর মাধ্যমে
বলেছেন--
‘প্রেয়ো মিত্রং বন্ধুতা বা সমগ্রা
সর্বে কামাঃ শেবধির্জীবিতং বা।
স্ত্রীণাং ভর্তা ধর্মদারাচ্চ পুংসা-
মিত্যন্যোন্যং
বৎস্যয়োর্জ্ঞাতমস্তু।।‘ (মালতীমাধব—৬.১৮)
(স্ত্রীদের কাছে তাদের
স্বামী এবং স্বামীদের কাছে তাদের ধর্মপত্নী হল সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তু, প্রিয় মিত্র, সমগ্র বন্ধুত্ব,
সমস্ত চাওয়া-পাওয়ার আধার, পরম আশ্রয় ও জীবন স্বরূপ। অর্থাৎ এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে
আবদ্ধ, জগতের শ্রেষ্ঠ রত্ন।)
উত্তরচরিতে
দাম্পত্য-প্রেমের রূপ সম্বন্ধে রামের অনুভূতি--
‘অদ্বৈতং সুখদুঃখয়োরনুগতং
সর্বাস্বস্থাসু যদ্
বিশ্রামো হৃদয়স্য যত্র জরসা
যস্মিন্নহার্য্যো রসঃ।
কালেনাবরণাত্যয়াৎ পরিণতে যৎ
প্রেমসারে স্থিতং
ভদ্রং তথা সুমানুষস্য কথম্যেকং হি তৎ
প্রার্থ্যতে।।‘ (উত্তরচরিত—১.৩৯)
(যা সুখে ও দুঃখে সকল অবস্থাতে একইরকম (অদ্বৈত) অনুভূতি
জন্মায়, হৃদয় যাতে বিশ্রাম লাভ করে, বৃদ্ধ বয়সের জরাও যার রস অপহরণ করতে পারে না,
কালক্রমে সমস্ত লজ্জা সঙ্কোচ প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে গেলে যা প্রেমের সাররূপে পরিণত
হয়, বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী কোন সৎ মানুষই সেই পরম কল্যাণময় প্রেমসার লাভ করতে
পারে।)
দাম্পত্যপ্রেম অদ্বৈত, এর মধ্যে কোন দ্বৈত ভাব নেই। তা সুখে
দুঃখে সকল অবস্থাতে একই রকম থাকে। জরা, বার্ধক্য
আমাদের শরীরকে জীর্ণ করলেও সেই সুমানুষের লভ্য দাম্পত্য প্রেমের কখনও কোন
পরিবর্তন হয় না।
উত্তরচরিতের ১ম অঙ্কের ৩৮ নং শ্লোকে তাঁর ঘুমন্ত সীতাকে
দেখে রাম বলেছেন—
‘ইয়ং গেহে লক্ষ্মীরিয়মমমৃতবর্তির্নয়নয়ো-
রসাবস্যাঃ স্পর্শো বপুষি
বহুলশ্চন্দনরসঃ।
অয়ং বাহুঃ কণ্ঠে শিশিরমৌক্তিকরসঃ
কিমস্যা ন প্রেয়ো যদি পরমসহ্যস্তু
বিরহঃ।।‘
--এই সীতা আমার গৃহের লক্ষ্মী, আমার দু’চোখের কাজল-বর্তিকা,
এর স্পর্শ আমার দেহে চন্দন-রসের মত, আমার কণ্ঠে এর বাহু মুক্তামালার মত শীতল ও
সুখস্পর্শ। তার কোন্ বস্তুই বা আমার প্রিয় নয়, কেবল অসহ্য তার বিরহ।
এর তুলনা
বিশ্বসাহিত্যে বিরল।
সীতার মুখের কথা রামের কত প্রিয় সে সম্বন্ধে রাম বলেছেন—
‘ম্লানস্য জীবকুসুমস্য বিকাশনানি
সন্তর্পণানি সকলেন্দ্রিয়-মোহনানি।
এতানি তে সুবচনানি সরোরুহাক্ষি
কর্ণামৃতানি মনসশ্চ রসায়নানি।।‘ (উত্তর চরিত –১.৩৬)
(‘তোমার কথা আমার ম্লান জীবনকুসুমকে বিকশিত করে, আমার সকল ইন্দ্রিয়ে মোহের সঞ্চার
করে, তোমার সুন্দর সুন্দর মিষ্টি কথা আমার কর্ণে অমৃত সিঞ্চন করে, এবং মনে জীবনের
রস সঞ্চার করে।)
এই রকম অকপট গভীর অনুভূতির কথা আমি কোথাও শুনেছি বলে মনে
পড়ে না।
এ তো গেল রামের কথা। এবার সীতা কী বলেছেন দেখা যাক—
‘অহমেবৈতস্য হৃদয়ং জানামি মমৈষ।‘
--‘আমি এর হৃদয়কে জানি, আমার হৃদয়কে এ জানে।‘
গভীর বিশ্বাস, ভালবাসা ও নির্ভরতা না থাকলে এই রকম কেউ বলতে
পারে না।
এর চেয়ে বড় আর কোন কথা হয় না।
ভবভূতি বিশ্বাস করতেন—দাম্পত্যপ্রেম পূর্ণতা লাভ করে
সন্তানের মাধ্যমে। সে সন্তান হচ্ছে স্নেহের আশ্রয়। পিতামাতার আনন্দগ্রন্থি হচ্ছে
সন্তান। তাঁদের অন্তঃকরণকে সন্তানরূপ আনন্দগ্রন্থিই বেঁধে রাখে। সন্তানের মধ্যেই
মূর্তিমান হয়ে ওঠে পিতামাতার প্রেম। সন্তানই দাম্পত্যপ্রেমকে সুদৃঢ করে—
‘অন্তঃকরণস্য দম্পত্যোঃ
স্নেহসংশ্রয়াৎ।
আনন্দ গ্রন্থিরেকোঽয়পত্যমিতি
বধ্যতে।।‘
এটা এক প্রকার মানস মোহগ্রন্থি যা চেতনাবানদের সংসারসূত্রকে
অবিচ্ছিন্ন রাখে—
‘সর্বসাধারণো হ্যেষ মানসো
মোহগ্রন্থিরান্তরশ্চেতনাবতামুপপ্লবঃ সংসারতন্তুঃ।‘
এরপর বললেন— ‘প্রসবঃ খলু প্রকর্ষপর্যন্তঃ স্নেহস্য। পরং
চৈতদ্ অন্যোন্য সংশ্লেষণং পিত্রোঃ।‘
--সন্তান হচ্ছে দাম্পত্যপ্রেমের পরাকাষ্ঠা এবং পিতা-মাতার সংযোজনগ্রন্থি।
মহাবীরচরিতের ৪র্থ
অঙ্কে বশিষ্ঠের প্রতি মহর্ষি বিশ্বামিত্রের একটি সংলাপে তাঁর সুখী দাম্পত্য
জীবনের চিত্র ফুটে উঠেছে—
‘ভগবন্, যদি অনুরুধ্যসে তদেহি
সিদ্ধাশ্রমপদমুভৌ গচ্ছাবঃ। ত্বাং পুরস্কৃত্য গচ্ছন্ মধুচ্ছন্দসো মাতুঃ সৎকার্যো
ভবিষ্যামি।‘
বিশবামিত্র বশিষ্ঠকে ‘আমাদের আতিথ্য গ্রহণ করুন’ –এই ধরণের
কথা বলেন নি, বলেছেন—
‘ মধুচ্ছন্দসো মাতুঃ সৎকার্যো
ভবিষ্যামি।‘
মধুচ্ছন্দাঃ বিশবামিত্রের পুত্রের নাম। মধুচ্ছন্দার মায়ের
আতিথ্য গ্রহণের কথা বলেছেন। মুনি ঋষিরা ব্রহ্মজ্ঞানী হলেও তাঁদের অনেকেই দাম্পত্য
জীবনকে অস্বীকার করেন নি।
এ তো গেল সামান্য
কয়েকটি কথা। হিন্দুবিবাহের অনেক মন্ত্রই বেদ থেকে নেওয়া। পরবর্তী সময়ে আরো
কিছু মন্ত্র যোগ করা হয়। পুরোহিতদর্পণ দেখলে আপনারা জানতে পারবেন।
অনেক নিয়ম আচার মেনে হিন্দুবিবাহের অনুষ্ঠান হয়। এই বিবাহের
বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ উভয় দিকই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর ও কনেকে নতুন জীবনে
প্রবেশের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হয় এবং পরিবার ও সমাজকেও এর সঙ্গে যুক্ত
করা হয়। নানা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এর পবিত্র ভাব বজায় রাখা হয়।
হিন্দুবিবাহের আচার অনুষ্ঠান যারা প্রবর্তন করেছেন, যারা এর
মন্ত্র রচনা করেছেন তারা অনেক দিক ভেবে চিন্তে সামগ্রিক কল্যাণের সঙ্গে একে যুক্ত
করে দিয়েছেন।
দু’জন যুবক-যুবতী পরস্পর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবে, তারা জানে
না এই সম্পর্কের স্বরূপ কি, পরস্পরকে কি চোখে দেখতে হয়, নতুন জীবনে তাদের ভূমিকা কি?
পুরোহিত বরকে দিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করান (বর বধূর উদ্দেশ্যে
বলেন)—
‘’ওম্ অন্নপাশেন মণিনা
প্রাণসূত্রেণ পৃশ্নিনা।
বধ্নামি সত্যগ্রন্থিনা
মনশ্চ হৃদয়ঞ্চ তে।।
ওম্ যদেতদ্হৃদয়ং
তব তদস্তু হৃদয়ং মম।
যদিদং হৃদয়ং মম তদস্তু
হৃদয়ং তব।।‘
--তোমার এই যে হৃদয় তা
আমার হোক, আর আমার এই যে হৃদয় তা তোমার হোক। এটাই হিন্দু বিবাহের মূল মন্ত্র। এক
সূত্রে বাঁধা হয় দুটি হৃদয়। বিশ্বাস, ভালবাসা, সততা –এই তিনটি গুণবিশিষ্ট এই
সূত্র।
পৃথিবীর আর কোন সভ্যতায়
দাম্পত্য সম্পর্কের এইরকম উচ্চ আদর্শের কথা আছে বলে মনে হয় না। এটাই প্রকৃত
সভ্যতা। এটাই সত্য, এর মধ্যেই আছে সৌন্দর্য
এবং সার্বিক কল্যাণ। এইভাবেই দাম্পত্যজীবনে সত্য, শিব ও সুন্দরের
প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমাদের চিন্তাবিদ্গণ সংসার ধর্মকে মহিমান্বিত করেছেন।
বিশ্বাস, ভালবাসা, সততা
–এই তিনটি গুণের একটি নষ্ট হলে দাম্পত্য সম্পর্কের বাঁধন আলগা হয়ে যায়। ক’জন আর
এগুলো মনে রাখে বা ভাবে? ফলে প্রায় ঘরেই
এখন অশান্তি। কারণ একটাই-- আমরা এই পবিত্র সম্পর্ক নিয়ে আদৌ ভাবি না।
আজকের এই অশান্ত সময়ে আমরা যদি এই দিকটা একটু ভাবি তাহলে কি কিছু কাজ হতে পারে?
------
Comments