৪. প্রাচীন ভারতীয় রসায়নশাস্ত্র—
৪. প্রাচীন ভারতীয় রসায়নশাস্ত্র—
ভূমিকা— ‘রস’
ও ‘অয়ন’ এই দুটি শব্দের সমন্বয়ে ‘রসায়ন’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে।শার্ঙ্গধর
রসায়নের স্বরূপ সম্বন্ধে বলেছেন-- ‘রসায়নঞ্চ
তজ্জ্ঞেয়ং যজ্জ্বরাব্যাধি-বিনাশনম্’। বিখ্যাত
রসায়নবিদ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেছেন—
‘In
the older works Rasayana (derived from rasa, juice, and ayana, way) means a
medicine preventing old age and prolonging life—the Elixir vitae. Later on
Rasayana was almost exclusively applied to the employment of mercury and other
metals in medicine and at present it means also alchemy (chemistry).’
ভারতবর্ষে রসায়নবিদ্যার উৎপত্তি
সুপ্রাচীন। কিন্তু বর্তমানে যাকে Chemistry
বলা হয়, প্রাচীন রসায়নবিদ্যার সঙ্গে তার কিছু
মৌলিক পার্থক্য আছে। প্রাচীন ভারতে Alchemy বা
কিমিয়া বিদ্যা
এবং আয়ুর্বেদের অনুশীলন থেকেই সম্ভবতঃ রসায়নবিদ্যার উৎপত্তি হয়েছিল। বিভিন্ন রোগের
চিকিৎসায় পারদ ও অন্যান্য ধাতুর জারণ, শোধন, মিশ্রণ প্রভৃতি প্রক্রিয়া, অর্ক বা
আরক নিষ্কাশন, ক্ষার ও অম্লপাতন, ভৈষজ্যের গুণাগুণ বিশ্লেষণ ইত্যাদি বিভিন্ন
প্রক্রিয়া আয়ুর্বেদের অন্তর্গত ছিল।
ভারতবর্ষে রসায়নবিদ্যার
ক্রমবিকাশ প্রধানতঃ চারটি স্তরে হয়েছিল—
১. প্রাক্ হরপ্পা, হরপ্পা ও
হরপ্পা-পরবর্তী যুগ (আনুমানিক ৪০০০-১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)
২. বৈদিকযুগ (আনুমানিক ১৫০০-৬০০
খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)
৩. বেদোত্তর যুগ
(আনুমানিক ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৮০০ খ্রিষ্টাব্দ)
৪. মধ্যযুগ (আনুমানিক ৮০০ খ্রিষ্টাব্দ
থেকে শুরু)
প্রাক্ হরপ্পা, হরপ্পা ও
হরপ্পা-পরবর্তী যুগ—
অখণ্ড ভারতবর্ষের বেলুচিস্তান ও সিন্ধ্ অঞ্চলের
অধিবাসীদের ব্যবহৃত তামার দ্রব্যসামগ্রী ও পোড়ামাটির জিনিসপত্র দেখে পণ্ডিতগণ
বলেছেন-- খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০-৩০০০ অব্দে
ভারতবর্ষে রসায়নবিদ্যার ভিত্তি স্থাপিত হয়। সিন্ধ্প্রদেশে মহেঞ্জোদরো ও পাঞ্জাবের
হরপ্পায় খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত ইট, জলের পাত্র, মৃৎপাত্র, অলঙ্কার, ধাতুদ্রব্য,
সীলমোহর প্রভৃতিতে অনেক রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হত। মৃৎপাত্র রঙ করার জন্য
ম্যাঙ্গানিজ অক্সাইড, কপার অক্সাইড এবং আয়রন অক্সাইড ব্যবহার করা হত।
বৈদিকযুগ— ঋগ্বেদে
সোনা, রূপা, তামা, ব্রোঞ্জ প্রভৃতির উল্লেখ আছে। সোনা অলঙ্কার তৈরিতে ব্যবহার করা
হত। বাসনপত্র ব্রোঞ্জ-নির্মিত ছিল। যজুর্বেদে টিন ও সীসার উল্লেখ আছে। ঋগ্বেদে
গাছপালার নির্যাস থেকে কাপড় রঙ করার কথা আছে। এ থেকে অনুমান করা যায় যে, বৈদিক
যুগে এই সমস্ত ব্যাপারে কিছু রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হত। বৈদিকযুগে দেবতাদের
উদ্দেশ্যে সোমরস আহুতি দেওয়া হত। বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক Acharya Prafulla Chandra Roy বলেছেন—
‘It will be seen later on that in the Soma rasa and its
attributes we have the dawn of Hindu Alchemy.’
বেদোত্তরযুগ—
এই যুগটি ভারতবর্ষের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় যুগ।
এই যুগে রসায়নবিদ্যা পুরোপুরি ঔষধশিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। এই সময়ের
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ-- কৌটিল্যের
অর্থশাস্ত্র, চরকসংহিতা, সুশ্রুতসংহিতা
প্রভৃতি।
অর্থশাস্ত্রে সোনা, রূপা, তামা, সীসা, টিন, পারদ
প্রভৃতি ধাতুর আকর থেকে নিষ্কাশনের পদ্ধতি আলোচিত হয়েছে।
চরকসংহিতায় বিভিন্ন খনিজ পদার্থ যেমন-- কপার
সালফেট, আয়রন সালফেট প্রভৃতির উল্লেখ আছে।
সুশ্রুতসংহিতায় অ্যালকালি কার্বোনেট, কস্টিক
অ্যালকালি-প্রস্তুতি, অ্যাসিডের দ্বারা অ্যালকালিকে অকেজো করে দেওয়ার বিবরণ দেওয়া
হয়েছে।
মধ্যযুগ—
এই যুগে রসায়নশাস্ত্র অ্যালকেমির সঙ্গে
ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। Practical
chemistry বলতে
যা বোঝায়, তা এই যুগ থেকে শুরু হয়। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলী—
রসরত্নাকর— এই
গ্রন্থটি বিখ্যাত বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুনের (৮০০ খ্রিষ্টাব্দ) নামে প্রচলিত।
এখানে জিঙ্ক, পারদ ও কপার তৈরির রাসায়নিক প্রক্রিয়া আলোচিত হয়েছে।
রসার্ণব বা দেবীশাস্ত্র (১২০০
খ্রিষ্টাব্দ)—এটি শৈব সম্প্রদায়ের তন্ত্রগ্রন্থ। এখানে মূলতঃ অ্যালকেমি ও রসায়নের
আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়া সালফিউরিক অ্যাসিড প্রস্তুতি ও পারদ বিশুদ্ধিকরণের
প্রক্রিয়াও আলোচিত হয়েছে।
অষ্টাঙ্গহৃদয়— বাগ্ভট
এর রচয়িতা। এখানে ঔষধ প্রস্তুতির উপাদান হিসাবে সোনা, রূপা, তামা, সীসা, লোহা
প্রভৃতি পদার্থ, খনিজ লবণ, পারদ প্রভৃতির উল্লেখ আছে।
রসহৃদয়-- ভগবদ্
গোবিন্দপাদ এর রচয়িতা। এখানে পারদ বিশুদ্ধিকরণের উপকরণ ও প্রক্রিয়া, আট প্রকার রস,
সোনা, রূপা, তামা, ছয় প্রকার লবণ প্রভৃতি এবং ঔষধশিল্পে এগুলির ব্যবহার আলোচিত
হয়েছে।
রসেন্দ্রচূড়ামণি-- সোমদেব এর
রচয়িতা। এই গ্রন্থে কিছু ধাতুর মিশ্রণের রাসায়নিক প্রক্রিয়া, এর জন্য প্রয়োজনীয়
সরঞ্জামের বিবরণ দেওয়া হয়েছে।
রসপ্রকাশসুধাকর-- যশোধর এর
রচয়িতা। এখানে কুষ্ঠরোগ-বিনাশক কর্পূররস (Calomel)
প্রস্তুতির বিবরণ আছে।
অন্যান্য প্রসিদ্ধ গ্রন্থ-- মদনান্ত
দেবসূরির রসচিন্তামণি, বিষ্ণুদেবের রসরাজলক্ষ্মী, মথনসিংহের রসনক্ষত্রমালিকা,
নিত্যনাথের রসরত্নাকর প্রভৃতি, এছাড়া রসরত্নসমুচ্চয়, রসপ্রদীপ, যুক্তিকল্পতরু,
শার্ঙ্গধরপদ্ধতি, কৌতুকচিন্তামণি,
ধাতুরত্নমালা, রসপ্রদর, সুবর্ণতন্ত্র ধাতুবাদ, সর্বেশ্বর রসায়ন প্রভৃতি গ্রন্থ
ভারতীয় রসায়নের ধারাকে সমৃদ্ধ করেছে।
উপসংহার--
ভারতবর্ষে রসায়নবিদ্যা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে
অর্জিত হয়েছিল। রসায়নের তত্ত্ব ও পরিবর্তনের প্রকৃতি না জেনে শুধুমাত্র বাস্তব
প্রয়োজনে মৃৎশিল্প, ধাতুশিল্প, ঔষধ প্রস্তুত প্রভৃতিতে তা ব্যবহার করা হত। এই
বিষয়ে চিন্তা ও ধারণা প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের অভাবে সেগুলি
বৈজ্ঞানিক নিয়ম ও তত্ত্বে পরিণত হতে পারে নি। তবুও খনিজশিল্পে, ধাতুশিল্পে,
প্রাত্যহিক জীবনে রাসায়নিক প্রক্রিয়ার ব্যবহারে, আকর থেকে ধাতু নিষ্কাশন প্রভৃতিতে
রাসায়নিক পদ্ধতির প্রয়োগ প্রাচীন ভারতীয় রসায়নবিদ ও ধাতুবিদদের উল্লেখযোগ্য
দক্ষতার সাক্ষ্য বহন করে।
----
Comments